Murshidabad Alkap উনিশ শতকের প্রথমে দিকে আলকাপ নাটকের চর্চা হলেও বিশশতকের গোড়ার দিকে গৌড়ীয় অঞ্চলে আলকাপের উল্লেখযোগ্য বিকাশ লক্ষ্য করা যায়। যদিও কালের গর্ভে আলকাপ কার্যত হারিয়ে যাচ্ছে। আলকাপ মুর্শিদাবাদ জেলায় প্রচলিত হলেও,মালদা, নদীয়া, বীরভূম, বর্ধমান, বাঁকুড়া, পাকুড়, বিহারের সাহেবগঞ্জ,বাংলাদেশের রাজশাহীতে স্বনামে কিংবা ভিন্ননামে প্রচলিত। লোককথা, সংলাপ, নৃত্য, গান বাদ্য সহযোগে হাস্যরসাত্মক সমাজ শিক্ষামূলক লোকনাট্য হল আলকাপ।
আলকাপ শব্দটি ‘আল’ ও ‘কাপ’ দুটি শব্দগুচ্ছের সমন্বয়ে গঠিত। ‘আল’ শব্দটি আহ্লাদের অপভ্রংশ, আহ্লাদ>আল্লাদ>আল। আরবি আল শব্দের অর্থ মস্তান, ফারসিতে আল শব্দের অর্থ লাল রঙ, বাংলা ভাষায় এর অর্থ হল কাঁটার বেড়া দেওয়া। পার্শি ভাষায় আল শব্দের অর্থ আধুনিক। প্রাচীন বাংলা ভাষায় আল শব্দের অর্থ ছল বা ওজর। মানিকচন্দ্রের গানে আমরা পাই –“ঔষধ করিবার আলে জন জন পালায়”। কাপ শব্দটি কাচ শব্দ থেকে এসেছে যার অর্থ কৌতুককারী ছদ্মবেশী বা কপটচারী। নগেন্দ্রনাথ বসু ‘বিশ্বকোষ’ গ্রন্থে কাচ বা সঙ থেকে কাপ শব্দের উৎপত্তি বলেছেন।
আলকাপের গানের শুরুতে আসর বন্দনায় শিব, দুর্গা, সরস্বতী, শ্যামা ইত্যাদি দেবদেবীর বন্দনা করা হয়। তাছাড়া আলকাপের স্রষ্টা বলে যিনি সর্বজনবিদিত তিনি হলেন অধুনা রাজশাহি শিবগঞ্জের মোনাকয়সার বোনাকানা বা বনমালী সরকার। সম্প্রীতির মেলবন্ধন ‘আলকাপ’ লোকনাট্য।
আবার মালদা জেলার আলকাপ শিল্পীদের কেউ কেউ মনে করেন “বোলবাহি” থেকে আলকাপের উৎপত্তি, তারা আলকাপের দ্বৈত সঙ্গীতের সঙ্গে খোট্টা ভাষায় রচিত “বোলবাহি” -র দ্বৈতসঙ্গীতের সাদৃশ্য দেখান। বোলবাহির একমাত্র আঙ্গিক “দ্বৈতসঙ্গীত’ কিন্তু আলকাপে দ্বৈতসঙ্গীত ছাড়াও কাপ, ছড়া, বৈঠকি গান ইত্যাদি আঙ্গিক থাকে। সৃতরাং আলকাপের উৎস ‘বোলবাহি’ও নয়।
মালদহ-মুর্শিদাবাদ জেলার সংলগ্ন বিহারের পূর্ণিয়া, সাহেবগঞ্জ প্রভৃতি জেলায় হিন্দি ভাষায় আলকাপের মত আঙ্গিক বিশিষ্ট ‘রাজধারী’ নামক এক ধরনের লোকনাট্য বর্তমান। রাজধারীর সঙ্গে সাদৃশ্য দেখে এককালের রাজধারী শিল্পী ও বর্তমানে আলকাপ শিল্পী শ্যামচন্দ্র মণ্ডলের অভিমত হল হিন্দীতে যা ছিল ‘রাজধারী’ বাংলায় তা হল ‘আলকাপ’।
এ প্রসঙ্গে বলা যায় যে, একটা লোকনাট্যের সঙ্গে অন্য লোকনাট্যের বৈশিষ্ট্য ও আঙ্গিকগত কিছু মিল অবশ্যই থাকতে পারে, কিন্তু একটি থেকে যে অন্যটি সৃষ্ট তার জোরালো যুক্তি আলকাপের ক্ষেত্রে দেখা যায় না।
আলকাপের উৎপত্তি প্রসঙ্গে আর যে অভিমত আলকাপ শিল্পীদের কাছে পাওয়া যায় তা হল, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের মাধ্যম হিসাবে আলকাপের উৎপত্তি। ব্রিটিশ সরকার গান-বাজনা সভা-সমিতি সব কিছু নিষিদ্ধ কবলে গ্রামের শিল্পীরা বনের মধ্যে গিয়ে কেউ রাজা, কেউ প্রজা, কেউ জমিদার সেজে অভিনয় করত এবং কেউ জিজ্ঞাসা করলে বলত আলকাপ করছি। আলকাপের নাম করে অভিনয়ের মাধ্যমে ইংরেজ সরকারের অত্যাচার, নিপীড়ন, দোষ-ত্রুটিগুলি জনসমক্ষে তুলে ধরে মানুষকে সচেতন করে তুলত।
অনেকে মনে করেন “আলকাটা কাপ” থেকে আলকাপ শব্দের উৎপত্তি। আলকাটা কাপের অর্থ কীট পতঙ্গের বিষাক্ত হুলের মতো তীব্র যন্ত্রনাদায়ক ঠাট্টা বা মশকরা। আলকাপ সমাজ বা ব্যক্তি বিশেষকে আক্রমন করে গাওয়া এমন ঠাট্টা মশকরা যা তীক্ষ্ণভাবে ব্যক্তি বা সমাজকে আক্রমন করে।
আলকাপের বিখ্যাত শিল্পী ঝাঁকসু যদিও বলেছিলেন – “আলকাপ হল রগড়, হাসি-তামাসা, মেয়েছেলেদের কিচ্ছা, আলকাপ হত মাঠে ঘাঠে (মাঠের প্রান্তে) গাঁ ঘরে হত না। যখন ব্রিটিনিয়া সরকার (ব্রিটিশ সরকার) আমাদের দেশে এলো তখন অনুচরদের বলত কি হচ্ছে, না ওটা আলকাপ হচ্ছে। গম্ভিরা হচ্ছে রাষ্ট্র লিয়ে আলকাপ হচ্ছে পরিবার লিয়ে।”
মুর্শিদাবাদে ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে নানা নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে এগিয়েছে আলকাপ। শিল্পীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেনঃ ধনপত নগর জঙ্গিপুরের ধনঞ্জয় সরকার ওরফে ঝাঁকসা,রাজনগর জঙ্গিপুরের সুবল সরকার ওরফে সুবল কানা, খোসবাসপুরের সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ ওরফে ওস্তাদ সিরাজ মাস্টার,কৃষ্ণপুর সাগরদিঘির মহ নইমুদ্দিন মন্ডল ওরফে ওস্তাদ নইমুদ্দিন,সুপারিগোলা রানীনগরের কালান্দর খাঁ ওরফে ওস্তাদ বিদু খাঁ, নশিপুর হরিহরপাড়ার ওয়াসেফ আলী,কলাডাঙ্গা ইসলামপুরের ফটিক মৈত্র, প্রদীপডাঙ্গা হরিহরপাড়া সামসের সেখ,গোঘাটা নওদার সারাফত সেখ ওরফে ওস্তাদ সারু, এলাহিগঞ্জ লালবাগের ইয়াকুব সেখ, ফিরোজপুর ডোমকলের আফাজুদ্দিন সেখ, শিঙা লালবাগের পাতু মন্ডল ওরফে ওস্তাদ পাতু, বেজপাড়া বহরমপুরের মতলেব সেখ,উস্তিয়া বহরমপুরের নিয়ামত সেখ, ঘাসিপুর দৌলতাবাদের আমির সেখ, কুমনগর হরিহর পাড়ার আব্দুল মজিদ, সাগরদিঘির সুধীর দাস, মালিপাড়া রানীনগরের খোদাবক্স সেখ,ডোমকলের কালীপদ দাস, লালবাগের বনমালী দাস, হরিহরপাড়ার আবুল কাশেম মন্ডল প্রমুখের নাম বিশেভাবে উল্লেখযোগ্য। আলকাপগানের সর্বাধিক জনপ্রিয় ও আদি ওস্তাদ ধনঞ্জয় মন্ডল ওরফে ঝাঁকসা বা ঝাঁকসু দীর্ঘ পাঁচ দশকের বেশী সময় আলকাপ গানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কথাকার সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ভাষায় – “আলকাপকে নোংরা ধুলো-বালি থেকে কুড়িয়ে মানুষ করেছিলেন ওস্তাদ ঝাঁকসা।”
( ঋণঃ অধ্যাপক প্রভাত দাস এবং মহম্মদ নুরুল ইসলাম )